মিশরীয় সমাধিস্থকরন আর প্রাচীন মিশরীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান সমার্থক শব্দ, যার সাথে মৃত্যু এবং পরকালের জীবনে আত্মার ভ্রমণ সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তা জড়িয়ে ছিল। অনন্তকাল ব্যাপারটা, গবেষক পণ্ডিত মার্গারেট বানসনের মতে, "প্রাচীন মিশরের প্রতিটা পুরুষ, মহিলা এবং শিশুর আবশ্যিক গন্তব্যস্থল ছিল" (৮৭) তবে সেটা মেঘের উপরে অবস্থান করা এক পরকালের জীবনরূপী 'অনন্তকাল' নয় বরং এক চিরন্তন মিশরীয় জীবনযাত্রা যা পৃথিবীতে একজন তার জীবনকালে উপভোগ করে এসেছে।
প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে পরবর্তী জীবনের নাম ছিল ‘দ্য ফিল্ড অফ রিডস’ (আরু)। যা পৃথিবীতে বসবাসকারী জীবনের একটি নিখুঁত প্রতিরূপ। মৃত্যুর কারণে একজনের জীবন থেকে যা যা হারিয়ে গেছে বলে ভাবা হয়ে থাকে, তা পরকালে এক আদর্শ রূপ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। সেখানে তার পার্থিব সব জিনিসপত্র মৃতদেহের সাথে রাখার ব্যবস্থা করা হয় যাতে, ওই জগতে কোন অসুবিধা না হয়।
মিশরে প্রাক সাম্রাজ্য যুগেও (আনুঃ. ৬০০০ - ৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অনন্তকালের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং শেষকৃত্যের এই রীতি প্রচলিত ছিল। মিশরের গেবেলিন-এ আবিষ্কার হয়েছে আজ অবধি কোনও সমাধি থেকে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীনতম সংরক্ষিত মৃতদেহ, যা ‘জিঞ্জার’ নামে পরিচিত। সময়কাল ৩৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। যেখানে পরকালের জন্য কবরের ভিতর নানা সামগ্রী দেওয়া হয়েছিল। প্রাক সাম্রাজ্য এবং টলেমাইক রাজবংশের যুগে (৩২৩-৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, মিশর রোমান প্রদেশে পরিণত হওয়ার আগে শেষ মিশরীয় যুগ) সময়ের সাথে সাথে শেষকৃত্যের রীতিগুলো বদলে গেলেও মূল নজর কিন্তু ছিল অনন্ত জীবন এবং মৃত্যুর পরে ব্যক্তিগত অস্তিত্ব বজায় রাখাটাকে নিশ্চিত করার দিকেই। এই বিশ্বাস ব্যাবসা-বাণিজ্যের সূত্রে (বিশেষ করে সিল্ক রোডের মাধ্যমে) সাংস্কৃতিক সংক্রমণের মতো প্রাচীন বিশ্বে সুপরিচিত হয়েছিল। যা অন্যান্য সভ্যতা ও ধর্মকেও প্রভাবিত করে ছিল। মনে করা হয় খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গির স্বর্গ ভাবনার এগুলোই ছিল অন্যতম অনুপ্রেরণা । অন্যান্য সংস্কৃতিতে সমাধি প্রথা চালু হওয়ার প্রধান প্রভাব হিসাবেও নিশ্চিতভাবে কাজ করেছে মিশরীয়দের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান।
শোক এবং আত্মা
হেরোডোটাসের (৪৮৪-৪২৫/৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) মতে, কবর দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৃতদের উদ্দেশে শোক পালন করার মিশরীয় আচারগুলো খুবই নাটকীয় ছিল। আশা করা হত যে, মৃত ব্যক্তি কবরের জগতের অন্যপারে অবস্থিত চিরন্তন ভূমিতে আনন্দময় জগত পাবেন। উনি লিখে গেছেন:
শোক এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ক্ষেত্রে, যখন কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি মারা যেত, তখন বাড়ির সমস্ত মহিলারা তাদের মাথা এবং মুখে কাদার প্রলেপ দিত। তারপর মৃতদেহটা বাড়ির ভিতরে রেখে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের সাথে নগর পরিক্রমায় বের হত। পোশাক বাঁধা থাকত কোমরে কোমরবন্ধনী দিয়ে। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে তারা এগিয়ে যেত পথ ধরে। . পুরুষরাও তাদের তরফ থেকে, একই পদ্ধতি অনুসরণ করে, কোমরবন্ধ পরিধান করে এবং নারীদের মতো নিজেদের বুক চাপড়াত। এই অনুষ্ঠান শেষে তারা দেহটাকে মমি করার জন্য নিয়ে যেত। (নারদো, ১১০)
মিশরে ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের প্রথম দিকেই মমিকরণের প্রথা চালু হয়েছিল। সে সময় শুষ্ক বালিতেই মৃতদেহ পুঁতে রেখে বা সমাধিস্থ করে দেহ সংরক্ষণের চেষ্টা করা হত বলে মনে করা হয়। আত্মা বিষয়ে মিশরীয় ধারণা – যেটা সম্ভবত আরও আগে থেকেই বিকশিত হয়েছিল - নির্দেশ করে যে, আত্মার অনন্ত জীবনের আশা নিশ্চিত করার জন্য পৃথিবীতে তার সংরক্ষিত দেহ থাকা দরকার। আত্মা ন’টা পৃথক অংশ নিয়ে গঠিত বলে মনে করা হত:
- ‘খাট’ বস্তুগত দেহ
- ‘কা’ একজন মানুষের প্রতিরূপ
- ‘বা’ এক’ মানুষের মাথাওয়ালা পাখি। যে পৃথিবী এবং স্বর্গের মধ্যে যাতায়াত করতে পারে
- ‘শুয়েট’ মানুষটার ছায়ারূপ বা দেহ
- ‘আখ’ অমর, রূপান্তরিত আত্মরূপ
- ‘সাহু’ এবং ‘সেচেম’ আখের রূপভেদ
- ‘আব’ হল হৃদয়, ভালো মন্দের উৎসস্বরুপ
- ‘রেন’ একজন মানুষের গোপন নাম
‘কা’ এবং ‘বা’ নিজেকে চিনতে পারার জন্য ‘খাট’য়ের অস্তিত্ব থাকা দরকার এবং তাই জন্য দেহটাকে যতটা সম্ভব অক্ষত রাখতে হবে।
একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর, তার পরিবার মৃত ব্যক্তির দেহটাকে দেহ সংরক্ষণ কারীদের কাছে নিয়ে যেত। “যেখানে ওই পেশাদার মানুষেরার গুণমান অনুসারে কাঠের নমুনা মডেল তৈরি করে দেখাত। জেনে নিত তিন ধরণের পদ্ধতি আছে কোনটা প্রয়োজন। মৃতের পরিবার, তারজন্য প্রদেয় মূল্যের বিষয়ে সম্মত হয়ে, বাকি কাজ দেহসংরক্ষণকারীদের হাতে ছেড়ে দিত" (ইকরাম, ৫৩)। মিশরীয় শেষ কৃত্য করার তিন রকম গুণমানের পদ্ধতি ছিল এবং সেই অনুসারে সংশ্লিষ্ট মূল্য প্রদান করতে হত। পেশাদার দেহসংরক্ষণকারীরা শোকাহতদের এর ভিতর থেকে পছন্দ করার প্রস্তাব দিত। হেরোডোটাসের মতে: "সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল পদ্ধতিটা ওসাইরিসকে প্রতিনিধিত্ব করত। এর পরের স্তর ছিল তুলনায় কিছুটা নিকৃষ্ট এবং সস্তা এবং তৃতীয় পদ্ধতি সবথেকে সস্তা" (নারদো, ১১০)।
মমি নির্মাণের প্রকারভেদ
সমাধিস্থ করার আগে এই তিনটি পছন্দ নির্দেশ করে যে, কোন ধরনের কফিনে একজনকে কবর দেওয়া হবে, সাথেই কেমন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করা হবে এবং মৃতদেহের সংরক্ষণ কীভাবে করা হবে। গবেষক সালিমা ইকরামের মতে:
মমিকরণের মূল উপাদান ছিল ন্যাট্রন বা নেটজরি/নেটিরি, যা ঐশ্বরিক লবণ বলে বিবেচিত। এটা আসলে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট, সোডিয়াম কার্বনেট, সোডিয়াম সালফেট এবং সোডিয়াম ক্লোরাইডের মিশ্রণ যা কায়রো থেকে প্রায় চৌষট্টি কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ওয়াদি নাট্রুনে। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যেত। এর ডেসিকেটিং [শুকনো করা] এবং ডিফ্যাটিং [চর্বি গলানো] করার ক্ষমতা আছে। এই বিশেষ কাছে এটাই ছিল প্রথম পছন্দের বস্তু। যদিও সাধারণ লবণও ব্যবহার করা হত খরচ করার ক্ষমতা না থাকলে। (৫৫)
সবচেয়ে ব্যয়বহুল ধরণের শেষকৃত্য ক্ষেত্রে, মৃতের দেহটাকে একটা টেবিলের মতো স্থানে শুইয়ে রাখা হত। মস্তিষ্ক বের করে আনা হত লোহার হুক
দিয়ে নাসারন্ধ্রের মাধ্যমে এবং হুক দিয়ে যা বার করা যেত না তা ওষুধ দিয়ে ধুয়ে ফেলা হতও। এর পরে চকমকি পাথরের ছুরি দিয়ে পেটের চামড়া কেটে ফেলা হত বার করে আনা হত পেটের ভিতরের সব কিছু। প্রথমে ‘পাম ওয়াইন’ দিয়ে ধুয়ে নেওয়া হত পেটের ভিতরটাকে। তারপর নানান মশলা দিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিষ্কার করা হত এবং পুনরায় ধুয়ে ফেলা হত। এর পর খাঁটি গন্ধরস বা বিশেষ গাছের আঠা, দারচিনি সহ নানান সুগন্ধযুক্ত পদার্থ [লোবান বা ‘ফ্র্যাঙ্কিন্সেন্স’ বাদে] ভর্তি করে কাটা জায়গা সেলাই করে দেওয়া হত। এবার দেহটা ন্যাট্রনের উপর রেখে আরও ওই বস্তু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত - তার চেয়ে একদিন বেশি হত না কখনও। এই সময়কাল শেষ হয়ে গেলে, শরীরটাকে ধুয়ে ফেলে লিনেন কাপড়ের টুকরো দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হত মাথা থেকে পা অবধি। যে কাপড়ের নিচের দিকে লাগানো থাকত প্রাকৃতিক আঠা[গাম]। মিশরীয়রা ‘গ্লু’ বা বানানো আঠা ব্যবহার করত না । এই অবস্থায় মৃতদেহটাকে তার পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হত একটা কাঠের ’শবাধার’ সমেত। যা বাইরে থেকে দেখতে একটা মানুষের মত । ওটার ভিতরেই দেহটা রাখা হত সমাধিস্থ করার সময় (ইকরাম, ৫৪, হেরোডোটাসের উদ্ধৃতি অনুসারে)
দ্বিতীয় স্তরের ব্যয়যুক্ত পদ্ধতি নিশ্চিতভাবেই প্রথমটার থেকে আলাদা ছিল। যেখানে মৃতদেহকে কম যত্ন করা হত।
দেহে কাটাকুটি কিছু করা হত না। শরীরের অন্ত্র আদি বার করাও হত না। তবে সিডারের তেল মলদ্বার দিয়ে শরীরে একটা সিরিঞ্জের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। তেল যাতে বের হয়ে না আসতে পারে তার জন্য মলদ্বারের ফুটো বন্ধ করে দেওয়া হত। এর পরে শরীরকে নির্ধারিত সংখ্যক দিনের জন্য ন্যাট্রনের ভিতর রেখে দিয়ে নিরিদিষ্ট সময়ের পর দেহের ভিতর স্থিত তেল বের করে দেওয়া হত। ওই তেল এবং ন্যাট্রনের প্রভাব এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, দেহের মাংস এবং অন্তস্থিত সব অঙ্গাদি গলে তরল অবস্থায় পরিণত হত। চামড়া এবং হাড় ছাড়া শরীরের কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। এই বিশেষ পদ্ধতির পরে, আর কিছু না করেই দেহটা পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হত। (ইকরাম, ৫৪, হেরোডোটাসের উদ্ধৃতি অনুসারে)
তৃতীয়, এবং সবচেয়ে সস্তা, দেহ সংরক্ষণের পদ্ধতিটা ছিল এরকম - "শুধুমাত্র অন্ত্রগুলো বার করে দিয়ে শরীরটাকে সত্তর দিন ন্যাট্রনে রেখে দেওয়া হত" (ইকরাম, ৫৪, হেরোডোটাসের উদ্ধৃতি অনুসারে)। মৃতদেহ সংরক্ষণে সহায়তা করার জন্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো সরানো হত এই পদ্ধতিতে। কিন্তু, যেহেতু বিশ্বাস করা হত যে, মৃত ব্যক্তির এখনও ওগুলোর প্রয়োজন হবে, তাই সেগুলো কিছু ক্যানোপিক জারে বা ঢাকনা লাগানো পাত্রে রেখে দিত। দেহের অভ্যন্তরে শুধুমাত্র হৃদপিন্ড থেকে যেত। কারণ বিশ্বাস অনুসারে ওটা আত্মার ‘আব’কে ধারণ করে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং কবর/সমাধি
আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন সবচেয়ে দরিদ্র মিশরীয়কেও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সামান্যতম অনুষ্ঠান বা রীতি পালন করতেই হত। কারণ, মনে করা হত যে, যদি মৃত ব্যক্তিকে সঠিকভাবে সমাধিস্থ করা না হয়, তবে তার আত্মা জীবিতদের ভয় দেখানোর জন্য ভূতের আকারে ফিরে আসবে। সেই সময়ে ভূত এক খুব বাস্তব বা বিশ্বাসযোগ্য এবং গুরুতর হুমকি হিসাবে বিবেচিত হত। শোকার্ত পরিবারগুলো মৃত ব্যক্তির আত্মাকে খুশি রাখতে এবং পরিবারের জীবিত সদস্যদের ভূতের উপদ্রব মুক্ত রাখার জন্য যতদুর সম্ভব শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানের খরচ বহন করার প্রচেষ্টা করত।
যেহেতু মমিকরণ পদ্ধতি খুব ব্যয়বহুল ছিল, তাই দরিদ্র মানুষেরা মৃতদেহকে মোড়ানোর জন্য তাদের ব্যবহৃত পোশাক মৃতদেহ সংরক্ষণকারীদের দিত। এর সূত্রেই এক শব্দবন্ধ জন্ম নেয়, ‘দ্য লিনেন অফ ইয়েস্টারডে’। বানসনের লেখায় পাওয়া যাচ্ছে, "গরীবরা নতুন লিনেন কিনতে পারত না, তাই তাদের প্রিয় মৃতদেহগুলিকে 'গতকালের' কাপড় মুড়ে রেখে দিত" (বানসন, ১৪৬)। সময়ের সাথে সাথে, এই শব্দবন্ধর ব্যবহার হতে থাকে তাকে উদ্দেশ্য করে, যে মারা গেছে। ব্যবহার করে ‘কাইটস অফ নেফথিস’ (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোক প্রকাশের জন্য কাজ করা পেশাদার নারী) রা তাদের বিলাপকালীন সময়ে।
বানসন জানিয়েছেন, “মৃত ব্যক্তিকে এই শোকার্তরা এমন একজন বলে সম্বোধন করছেন, যিনি সূক্ষ্ম এবং ভালো লিনেনের পোশাক পরতেন কিন্তু এখন তিনি 'গতকালের লিনেন' আবৃত হয়ে-এ ঘুমাচ্ছেন। এই লেখা এই সত্যকেই নির্দেশ করে যে, পৃথিবীর জীবন মৃতদের কাছে 'গতকাল' এ পরিণত হয়েছে" (১৪৬)। লিনেনের এই ‘ব্যান্ডেজ’ কে ‘দ্য ট্রেসেস অফ নেফথিস’ বা নেফথিসের কেশগুচ্ছ বলা হত। কারণ এই দেবী, আইসিসের যমজ বোন, মৃত্যু এবং পরকালের সাথে সম্পর্ক যুক্ত ছিলেন। দরিদ্র মানুষেরা সাধারণ কবরে নিজেদের প্রিয়জনদের সমাধিস্থ করতেন। সাথে দিত নিজেদের সামর্থ্য মতো সেই সব জিনিস যা ওই মানুষটা বেঁচে থাকা অবস্থায় উপভোগ করেছিল।
প্রতিটা কবরেই পরকালের জন্য কোন না কোন ব্যবস্থা করা থাকত। মিশরে সমাধিগুলো মূলত মাটিতে খনন করা সাধারণ ধাঁচের কবর ছিল। যা পরে আয়তাকার ‘মাস্তাবাস’য়ের রূপ নেয়। যা মাটির ইট দিয়ে তৈরি হত সুন্দর ভাবে অলঙ্কৃত করে। মাস্তাবাস [প্রাচীন ইজিপ্টের সমাধিগৃহ যার নিচে থাকত মূল কবর স্থান বা কফিন রাখার জায়গা। - অনুবাদক] ধীরে ধীরে রূপ নেয় 'স্টেপ পিরামিড' নামে পরিচিত কাঠামোয়। একসময় এর থেকেই 'প্রকৃত পিরামিড' গড়ে ওঠে। মিশরীয় সভ্যতার যত অগ্রসর হতে থাকে ততই এই সমাধিগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ এটাকেই তারা ‘খাট’ এর চিরন্তন বিশ্রামের স্থান বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। যাকে কবর চোর সহ নানান বিষয় থেকে রক্ষা করতে হবে এই ভাবনা মুখ্য হয়ে ওঠে।
কফিন বা ‘সারকোফ্যাগাস’টাও সুরক্ষিতভাবে মৃতদেহের প্রতীকী এবং ব্যবহারিক সুরক্ষার বিশেষ উদ্দেশ্যে নিয়ে বানানো হত। উল্লম্বভাবে সারকোফ্যাগাসের পিছনে হিয়েরোগ্লিফিস অক্ষর লেখা হত। যাকে মনে করা হত মৃত ব্যক্তির মেরুদণ্ডের প্রতিনিধি। বিশ্বাস অনুসারে এই লেখা মমিকে খাওয়া ও পান করার জন্য শক্তি প্রদান করে। মৃত ব্যক্তি কী করবে বা করবে না, সেই নির্দেশাবলী সারকোফ্যাগাসের ভিতরে লেখা থাকত। যা পরে পরিচিত হয় ‘কফিন টেক্সট’ নামে। (ব্যবহার করা হত আনুমানিক ২১৩৪-২০৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ) যা থেকে পরে ‘পিরামিড টেক্সট’ ( আনুঃ ২৪০০-২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রূপে বিকশিত হয়।
এইসব লেখাগুলো শেষ পর্যন্ত মিশরের নতুন সাম্রাজ্যের সময় (আনুঃ ১৫৭০- ১০৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আরও বিকশিত হয়ে ‘ইজিপশিয়ান বুক অফ দ্য ডেড’ এতে পরিণত হয়। (মিশরীয়দের কাছে এই পুস্তক ‘দ্য বুক অফ ক্যামিং ফোর্থ বাই ডে’ নামে পরিচিত, আনুঃ ১৫৫০- ১০৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। এই সমস্ত লেখা আত্মাকে মনে করিয়ে দেয় যে, তারা জীবিত অবস্থায় কে ছিল, তারা এখন কোথায় আছে এবং কীভাবে পরবর্তী জীবনে এগিয়ে যেতে হবে। ‘দ্য বুক অফ দ্য ডেড’ এই তিনটে বিষয়ের ভিতর একটা বিষয় সবচেয়ে বিস্তৃত আকারে জানিয়ে দিত, যা হলো পরবর্তী জীবনে কীভাবে আচার আচরণ করতে হবে।
সমাধির ব্যবস্থা করা, অবশ্যই, একজনের ব্যক্তিগত সম্পদের উপর নির্ভরশীল ছিল। তবে প্রত্যেকেই একটা কাজ করতই, ‘শাবতি’ পুতুল রাখত সমাধিস্থলের ভিতর । বাস্তব জীবনে, মিশরীয়দের প্রতি বছর নির্দিষ্ট কিছুটা সময় পিরামিড, উদ্যান বা মন্দিরের মতো জনগনের প্রকল্পে দান করার জন্য আহ্বান জানানো হত। কেউ অসুস্থ হলে বা সময় দিতে না পারলে একজন বদলি কর্মী পাঠাতে পারত। বছরে অন্তত একবার এটি করতে না পারলে, নাগরিক দায়িত্ব এড়ানোর দায়ে শাস্তির মুখোমুখি হতে হত।
মৃত্যুর পরেও, মনে করা হত, মানুষকে তখনও একই ধরণের সেবাকার্য করতে হবে (যেহেতু পরকাল পার্থিব জগতেরই এক ধারাবাহিকতা বলি তারা বিশ্বাস করত) এবং এ কারণে শাবতি পুতুল সমাধিতে রাখা হত। যারা আসলে সমাধিস্থ মানুষের প্রতিস্থাপন কর্মীর প্রতিভূর দায়িত্ব পালন করত। দেবতা ওসাইরিস যখন আহবান করবেন তখন এরা ওই মানুষের হয়ে কাজ করবে। সমাধিতে যত বেশি শাবতি পুতুল, সেখানে সমাহিত ব্যক্তির সম্পদ ততই বেশি এটাই প্রমাণিত। প্রতিটা শাবতি পুতুল শুধুমাত্র একবার প্রতিস্থাপন কর্মী হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। অতএব পুতুলের সংখ্যা বেশি রাখার দিকেই নজর থাকত ধনী মানুষদের। এই চাহিদার সূত্রেই এই পুতুল তৈরি করা এক আলাদা শিল্পর জগত তৈরি করেছিল। বেশিরভাগ শাবতি পুতুল কাঠ দিয়েই বানানো হত। তবে ফারাও বা অভিজাতদের জন্য মূল্যবান পাথর বা ধাতু দিয়েও এই পুতুল তৈরি করার অনুমতি ছিল ।
একবার মৃতদেহটাকে মমিতে রূপান্তরিত করা হয়ে গেলে এবং সমাধি প্রস্তুত করা হলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হত। যেখানে মৃত ব্যক্তির জীবনকে সম্মান জানিয়ে তার এই বিদায়কে ক্ষতি হিসাবে মেনে নিয়ে শোক প্রকাশ করত সকলে মিলে। মৃত ব্যক্তি জনপ্রিয় হলেও, শোককারীদের অভাব হত না। শেষকৃত্যের শোকযাত্রা এবং সমাধিস্থ করার সময় পাওয়া যেত ‘কাইটস অফ নেফথিস’ (সর্বদা নারীরাই এ দায়িত্ব পালন করত) দের। যারা অর্থের বিনিময়ে উচ্চস্বরে বিলাপ করত মৃত ব্যক্তির জন্য।
এরা ‘দ্য ল্যামেন্টেশন অফ আইসিস অ্যান্ড নেফথিস’ বা আইসিস এবং নেফথিসের বিলাপ নামক কাব্য পাঠ করত বা গাইত সুর করে। যা ওসাইরিসের মৃত্যুতে কাঁদতে থাকা দুই বোনের মিথ কাহিনি থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে এই ধর্মীয় কাব্য পাঠ অন্যদেরকে আবেগে মথিত করার জন্য বা দুঃখ প্রকাশ করতে সাহায্য করতে যে অনুপ্রাণিত করত তাতে সন্দেহ নেই। অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃতির মতোই, মৃতদের স্মরণ পরবর্তী জীবনে তাদের অব্যাহত অস্তিত্বকে নিশ্চিত করে বলেই মনে করা হত। এটাও ভাবা হত যে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোকের দুর্দান্ত প্রদর্শনের প্রতিধ্বনি যেখানে মৃতদের আত্মা বিচারের জন্য যায় সে ‘হল অফ ট্রুথ’ (হল অফ ওসাইরিস নামেও পরিচিত) এতে পৌঁছে যাবে।
প্রাচীন সাম্রাজ্যের সময়কাল ( আনুঃ ২৬১৩-২১৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে বা সমাধিতে মমি স্থাপনের আগে ‘ওপেনিং দ্য মাউথ’ নামে এক অনুষ্ঠান সম্পাদিত হত। এই অনুষ্ঠানটাও দৈহিক শরীরের গুরুত্বকেই পেশ করত। আত্মা যাতে মৃত্যুর পরেও দেহটাকে ব্যবহার করতে পারে তার জন্য মৃতদেহকে পুনর্জীবিত করার আচার পালন করা হত। একজন পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে এক বিশেষ ধারালো চাকুর মত ফলা দিয়ে মৃতদেহের মুখ স্পর্শ করতেন। (যাতে মৃতদেহ আবার শ্বাস নিতে পারে, খেতে পারে এবং পান করতে পারে) হাত ও পাও স্পর্শ করা হত ওই ফলা দিয়ে, যাতে সমাধিস্থলে চলাফেরা করতে পারে। একবার মৃতদেহকে সামধির ভিতর শুইয়ে দেওয়া হলে সমাধি স্থল সীলমোহর লাগিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হত। অন্যান্য নানান মন্ত্র পাঠ এবং প্রার্থনা চলত তার সাথে। যেমন ‘দ্য লিটানি অফ ওসাইরিস’(ফারাওয়ের ক্ষেত্রে, ‘দ্য পিরামিড টেক্সটস’) পাঠ করতে করতে মৃতকে পরলোকে যাত্রা শুরু করার জন্য ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসার পথ ধরত শোকার্ত পরিবার পরিজনেরা।
উপসংহার
সমাধিতে সীলমোহর লাগানোর কাজ সমাপ্ত করে, শোকার্তরা এক ভোজের আয়োজন করত। যা ছিল মৃত ব্যক্তির জীবনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করা। সাধারণত যেখানে সমাধিস্থ করা হত তার আশেপাশেই এই ভোজসভা অনুষ্ঠিত হত। এটা সমাপ্ত হলে বাকিরা নিজেদের তাদের বাড়িতে ফিরে যেত এবং তাদের প্রচলিত জীবন পুনরায় শুরু করত। ধরেই নিত বিদেহী আত্মা ইতিমধ্যে সেখানে তার অনন্ত যাত্রার পরবর্তী পর্বের সূচনা করে দিয়েছে। আত্মা সমাধির ভিতর জেগে উঠবে, আশ্বস্ত হবে ব্যবস্থাপনা দেখে। সারকোফ্যাগাসের গায়ে লেখা দ্বারা নির্দেশ গ্রহণ করবে এবং দেবতা আনুবিসের দেখানো পথে এগিয়ে যাবে সত্যি নির্ধারণের হল ঘরের দিকে। যেখানে ওসাইরিস এবং থথের তত্ত্বাবধানে বিদেহী আত্মার হৃদয় ওজন করবেন মা’ত দেবী, সাদা পালকের বিপরীতে।
যদি একজনের হৃদয় দেবী মা'আতের সত্য নির্ধারক পালকের চেয়ে ভারী রূপে পাওয়া যায়, তাহ্লে সেটা মেঝেতে ফেলে দেওয়া হবে। যা এক দৈত্য ভক্ষণ করে নেবে। ওই বিদেহী আত্মার অস্তিত্ব চিরতরে মুছে যাবে। যদি হৃদয় হালকা হয়, আত্মা শরকাঠির ক্ষেত্র নামক স্বর্গে যাওয়ার সুযোগ পাবে । যেখানে সে পাবে অনন্ত জীবন। কেউ সব নিয়ম মেনে পার্থিব জীবন যাপন করার পরে, যদি তার দেহকে যথাযথভাবে সমাধিস্থ করা না হলে এবং ঐতিহ্য অনুসারে সমস্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা না হলে কেউ এই স্বর্গে পৌঁছাতে পারে না। এই কারণেই সঠিকভাবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পালনের আচারগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এত কঠোরভাবে পালন করা হত।