প্রাচীন মিশরের দেব-দেবী - সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

5 দিন বাকি

ইতিহাস শিক্ষা বিনিয়োগ করুন

আমাদের দাতব্য বিশ্ব ইতিহাস ফাউন্ডেশনকে সমর্থন করে আপনি ইতিহাস শিক্ষার ভবিষ্যতে বিনিয়োগ আপনার অনুদান আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে তাদের চারপাশের বিশ্বকে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং দক্ষতা দিয়ে ক্ষমতায়িত করতে সহায়তা করে। সবার জন্য বিনামূল্যে আরও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য প্রকাশ করার জন্য প্রস্তুত নতুন বছর শুরু করতে আমাদের সহায়তা করুন।
$3774 / $10000

প্রবন্ধ

Joshua J. Mark
দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে, Pratim Das দ্বারা অনুবাদ করা হয়েছে
17 April 2016 এ প্রকাশিত 17 April 2016
অন্যান্য ভাষায় উপলব্ধ: ইংরেজি, চীনা, ফরাসি, পর্তুগীজ, স্পেনীয়
প্রবন্ধ মুদ্রণ করুন

প্রাচীন মিশরের প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল দেব-দেবীদের সত্তা এবং তাদের প্রভাব। সূর্য দেবতা রা প্রতিদিন সকালে অন্ধকারের ভিতর থেকে তার বিশাল নৌকায় বা বজরায় আলো নিয়ে আসতেন। একাধিক দেবতা রাতের বেলা নক্ষত্র রূপে এ জগতের মানুষের উপর নজর রাখতেন। ওসাইরিস নীল নদের জলের পরিমাণ বাড়িয়ে তীরভূমি প্লাবিত করতেন। যার ফলে চাষযোগ্য জমি হত উর্বর। খনুম নীলনদের প্রবাহ কোন দিকে বইবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। আইসিস এবং তার বোন নেফথিস মানুষের সাথে নিজেদের সংযোগ বজায় রাখতেন প্রতিমুহূর্তে এবং মৃত্যুর পরে তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব নিতেন। এই কাজটা অনেক দেবতাই করতেন। বাস্টেট মহিলাদের জীবন রক্ষা এবং বাড়িঘরের তত্ত্বাবধান করতেন। টেনেনেট ছিলেন উত্তেজক পানীয় এবং মদ্যপানের দেবী। সাথেই সন্তানের জন্মদানের সময়ও ইনি উপস্থিত থাকতেন। আবার হাথোর, যার অনেক রকম ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়। ইনি যে কোনও উত্সব অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে মিশে থাকতেন। কারণ তার পরিচিতিই ছিল মাতাল হওয়ার বা করার দেবী রূপে।

Ra Travelling Through the Underworld
রা পাতাল জগতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন
Unknown Artist (Public Domain)

মিশরের দেব-দেবীরা ভয় পাওয়ার মতো দূরবর্তী জগতের সত্তা ছিলেন না। এদের আচরণ ছিল অনেকটাই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো। তাদের জন্য নির্মিত মন্দিরসম বাড়ি, বিশেষ গাছ, হ্রদ, স্রোতধারা, জলাভূমি এবং নীল নদের উপত্যকার ওপারে থাকা মরুভূমিতে যারা মানুষের সাথেই বসবাস করতেন। যখন শুষ্ক কষ্টদায়ক গরম বাতাস বয়ে যেত সেটাকে মানুষ কেবলমাত্র সাধারণ বাতাস বলে মানুষ মনে করত না। তাদের মতে এটা দেবতা সেট দ্বারা সৃষ্ট কিছু ‘ঝামেলা’। যখন বৃষ্টি পড়ত মানুষের কাছে সেটা হত দেবী টেফনাটের উপহার। তাকে তারা ‘আর্দ্রতার ধারক নারী’ নামে উল্লেখ করত। যিনি আবার একই সাথে শুষ্কতার নিয়ন্ত্রকও ছিলেন। উৎসবের দিনে যাতে বৃষ্টি না হয় সেটাও দেখভাল করতেন উনি। আদি বিশৃঙ্খলার জল থেকে পৃথিবীর সৃষ্টি মুহূর্তে আটুম (রা নামেও যিনি পরিচিত) তার সন্তান শু এবং টেফনাটের প্রত্যাবর্তনের আনন্দে কেঁদেছিলেন। আর সেই চোখের জল থেকেই মানুষের জন্ম হয়েছিল। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে, মিশরের দেবতারা উপস্থিত থাকতেন এবং মৃত্যুর পরেও তাদের যত্নআত্তি করতেন।

দেবতাদের উৎপত্তি

অতিপ্রাকৃত সত্ত্বাদের প্রতি বিশ্বাস মিশরের প্রাক সাম্রাজ্য (আনুঃ ৬০০০-৩১৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সময়কালে যে ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিশ্বাস নিঃসন্দেহে আরও অনেক পুরনো সময়ের বিষয়। ইতিহাসবিদ মার্গারেট বানসন যেমন লিখেছেন:

মিশরীয়রা এমন প্রাকৃতিক শক্তিদের সাথে নিয়ে জীবনযাপন করত নিয়ে, যাদেরকে তারা বুঝতে পারেনি। ঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা এবং শুষ্ক/খরা সময় সবই তাদের বোধগম্যতার বাইরে বলে মনে হয়েছিল। মানুষ তীব্রভাবে উপলব্ধি করেছিল যে, এইসব প্রাকৃতিক শক্তি মানুষের জীবনক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। এসব শক্তি থেকে মানুষের যে ক্ষতি হয় বা হতে পারে, এই ভাবনা থেকেই তারা প্রকৃতির এই সব অজানা ‘শক্তি’কে ক্ষমতাশালী বিশেষ সত্ত্বা বলে মনে করা শুরু করে।

দেবতাদের বিষয়ে প্রাথমিক বিশ্বাস অ্যানিমিজমের রূপ নিয়েছিল। এই বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল এই ভাবনা থেকে - সমস্ত জড় বস্তু, গাছপালা, প্রাণী, পৃথিবী ইত্যাদির আত্মা [সোল] আছে এবং তারা ঐশ্বরিক স্ফুলিঙ্গের অধিকারী। এরসাথেই ছিল আরও দুটো ভাবনা। ফেটিসিজম, এই বিশ্বাস অনুসারে, একটি বস্তুর চেতনা এবং অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা রয়েছে। টোটেমিজম, এই বিশ্বাস অনুসারে, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট উদ্ভিদ, প্রাণী বা প্রতীকের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। প্রাক সাম্রাজ্যকালীন সময়ে অ্যানিমিজম ছিল মহাবিশ্বের প্রাথমিক উপলব্ধি। যে ভাবনা এ জগতের, যে কোনও সংস্কৃতির প্রাথমিক পর্বের মানুষের কাছেই ছিল। বানসন লিখেছেন, ‘অ্যানিমিজমের মাধ্যমে মানবজাতি প্রাকৃতিক শক্তি এবং পৃথিবীতে জীবনের যে ছক সেখানে মানুষের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল’। অ্যানিমিজম শুধুমাত্র উচ্চতর মহাজাগতিক শক্তি এবং পৃথিবীর শক্তির সাথে সম্পর্কিত নয়। এর সাথে সম্পর্ক আছে যারা মারা যায় তাদের আত্মারও। বানসন বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:

মিশরীয়রা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে, মৃত্যু অস্তিত্বের অন্য রূপে পৌঁছানোর একটি দরজা মাত্র। তাই তারা এই সম্ভাবনাকেও স্বীকার করেছিল যে, যারা মারা যায় তারা তাদের ওই নতুন জীবনে আরও শক্তিশালী হয়ে যায়। এইভাবে প্রতিটি সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক বা জাদু শক্তিতে শক্তিশালী সদস্যদের মৃত্যুর পর পরবর্তী জগতে তাদের বিশেষ তাত্পর্য সহকারে স্থান দেওয়া শুরু হয়। এই ধরনের আত্মাদের যথাযথ সম্মান, নৈবেদ্য প্রদান এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করা শুরু হয়েছিল। মৃত ব্যক্তিরা সাধারণ মানুষের ভাল থাকা বা অসুস্থতার জন্য দায়ী বলে মনে করা হত। জীবিতদের জীবনের নানান ক্ষেত্রে মৃতরা নিজেদের জড়িত করতে সক্ষম বলে মনে করা হতে থাকে, তা সে ভাল হোক বা মন্দ। আর এখান থেকে সুচনা হয় দিন-প্রতিদিনের ‘বলিদান’ বা নৈবেদ্য প্রদান পদ্ধতির। যাতে তাদের শান্ত রাখা যায়।

মৃত্যুর পরের জীবনকে বিশ্বাস অতিপ্রাকৃত সত্তাদের সাথে একটা বোঝাপড়ার জন্ম দিয়েছে। এই সূত্রেই সম্পূর্ণ অন্য ভাবনার জগতের এই বাসিন্দাদের সাথে পার্থিব জগতের এক অন্তহীন সম্পর্কের সুচনা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাসের এই প্রাথমিক বিবর্তন সম্ভবত এমিলি ডিকিনসনের ৯৬ নম্বর কবিতার লাইনে সোজা কথায় বিবৃত হয়েছে বলা যেতে পারে ( কবিতাটি ‘মাই লাইফ ক্লোজড টোয়াইস বিফোর ইট ক্লোজড’ নামে পরিচিত): পার্টিং ইজ অল উই নো অফ হেভেন। অথবা লারকিনের ‘ওহবাড’ থেকে উদ্ধৃত করা যায়, যেখানে বলা হচ্ছে ধর্ম আসলে ‘আমরা কখনই মরব না এমন ভান করার জন্য তৈরি করা হয়েছে’। মৃত্যুর অভিজ্ঞতাকে অনুভব করার জন্য এমন ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল, যা বুঝতে এক উচ্চতর ক্ষমতায় বিশ্বাস সৃষ্টি করার দরকার পড়ে। সেটাই করা হয়েছিল।

অ্যানিমিজম তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করে ফেটিসিজম এবং টোটেমিজমের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফেটিসিজমকে ডিজেড/ ডিয়েড-র প্রতীকরূপ উদাহরণ হিসাবে পেশ করা হয়েছে। যা পার্থিব এবং মহাজাগতিক স্থিতিশীলতার প্রতিনিধিত্ব করে। ডিজেড/ডিয়েড প্রতীকটি মূলত একটি উর্বরতার চিহ্ন বলে মনে করা হয়। যা ওসাইরিসের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল যে ‘ডিজেড/ডিয়েড তার পাশেই অবস্থান করছে’ এর মতো শিলালিপির লেখনীর অর্থ হিসাবে ধরেই নেওয়া হয়েছে যে, ওসাইরিসের মারা যাওয়া এবং ডিজেডের/ ডিয়েড-র উত্থান আসলে ওসাইরিসের পুনরুত্থানের প্রতীক। টোটেমিজম উদ্ভূত হয়েছে একটি নির্দিষ্ট উদ্ভিদ বা প্রাণীর সাথে স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পর্ক থেকে । প্রাচীন মিশরের প্রতিটি নোম (প্রদেশ) এর নিজস্ব টোটেম ছিল। গাছপালা, প্রাণী বা প্রতীক, যাই হোক না কেন তার সাথে ওই অঞ্চলের মানুষের আধ্যাত্মিক সংযোগকে নির্দেশ করত। প্রতিটি মিশরীয় সৈন্যবাহিনী এই নোম অনুসারে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে যাত্রা করত। প্রতিটি নোম তার টোটেম বা প্রতীক আলাদা করে পতাকার আকারে সাথে নিত। প্রতিটি ব্যক্তির নিজস্ব টোটেম ছিল। বিশ্বাস অনুসারে, যারা তাদের নিজস্ব আত্মার পথপ্রদর্শক। সাথেই যারা তাদের দিকে বিশেষভাবে নজর রাখে। মিশরের রাজাদের উপর, সমগ্র মিশরীয় রাজত্বের সময়কালেই এই বিশ্বাস বর্তমান ছিল, দেবতা হোরাসের প্রতিনিধিত্বকারী এক বাজপাখি নজরদারি করে।

সময়ের সাথে সাথে, এইসব বিশেষ সত্তারা [স্পিরিট] যাদের অ্যানিমিজমের মাধ্যমে উপলব্ধি করা হয়েছিল, তারা অ্যান্থ্রোম্রফিক (যারা মানুষ নয় তাদের উপর মানুষের বৈশিষ্ট আরোপ কর) ভাবনায় জারিত হয়। মহাবিশ্বে বসবাসকারী অদৃশ্য এই সব সত্ত্বাদের রূপ, আকৃতি এবং নাম দেওয়া শুরু হয়। এরাই রূপলাভ করেন প্রাচীন মিশরের দেবতা হিসাবে।

পৌরাণিক উৎস

মিশরীয়দের প্রাথমিক সৃষ্টি পৌরাণিক কাহিনী শুরু হয় সময়ের শুরুর আগে। যখন আদিম জল স্থির নিথর হয়েছিল। এই অন্তহীন, গভীরতার হিসাবহীন জলের মধ্যে থেকে উঠে আসে আদিম ঢিবি (বেন-বেন)। মিশরের পিরামিডগুলির ব্যাখ্যা হিসাবে আদিম গভীরতা থেকে উঠে আসা পৃথিবীর ওই প্রথম ঢিবির প্রতিনিধি বলা হয়ে থাকে। এই নীরব নিথর জল বা নুয়ের সাথে চিরকাল বিদ্যমান ছিল ছিলেন হেকা – জাদু। যাকে দেবতা হেকার মাধ্যমে মূর্তমান করা হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনীর কিছু সংস্করণে এই হেকা দেবতাই বেন-বেনের উত্থান ঘটিয়েছিলেন বলে উল্লেখ মেলে।

এই ঢিবির উপরেই দাঁড়িয়েছিলেন দেবতা আটুম (বা রা)। কিছু অন্য গল্প অনুসারে, উনি বাতাসের ভিতর থেকে ভেসে এসে এটির উপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আটুম চারদিকে শূন্যতা পর্যবেক্ষণ করার পর নিজের একাকীত্ব অনুভব করতে পেরেছিলেন। হেকার সহায়তায়, উনি নিজের ছায়ার সাথেই মিলিত হয়ে দুটি সন্তানের জন্ম দেন। শু (বাতাসের দেবতা, যাকে আটুম থুথু ফেলার ভঙ্গীতে জগতে এনেছিলেন) এবং টেফনাট (আর্দ্রতার অধিকারিণী দেবী, যাকে আটুম জগতে আনেন বমি করে)। শু প্রাথমিক সেই বিশ্বকে জীবনের নীতিগুলি প্রদান করেছিলেন। টেফনাট শৃঙ্খলার নীতিগুলি পেশ করেন।

পিতাকে বেন-বেনের উপর রেখে দিয়ে তারা চলে যান জগত সংসার প্রতিষ্ঠার জন্য। সময়ের সাথে সাথে, আটুম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কারণ তার সন্তানদের চলে যাওয়ার পর অনেকদিন কেটে গিয়েছিল। উনি নিজের একটা চোখ খুলে নিয়ে সেটাকে প্রেরণ করেন ওদের সন্ধান করার জন্য। যখন তার চোখ এই কাজে চলে যায়, তখন আটুম বিশৃঙ্খলার মধ্যে অবস্থানকারি ঢিবির উপর একা বসে অনন্তকালের ভাবনাচিন্তা করতে থাকেন। আটুমের চোখের সাথে ফিরে আসেন শু এবং টেফনাট (যে চোখ সব কিছু দেখে বা অ’ল-সিয়িং আই’ হিসাবে এটি বিখ্যাত)। নিরাপদে তাদের এই প্রত্যাবর্তন দেখে আটুম আনন্দে কেঁদে ফেলেন।

এই চোখের জল, বেন-বেনের অন্ধকার, উর্বর পৃথিবীতে পড়ে। জন্ম হয় নারী ও পুরুষের। এই নতুন প্রাণেদের বসবাসের কোন জায়গা ছিল না। অতএব গেব (পৃথিবী) এবং নাট (আকাশ)কে জন্ম দেওয়ার জন্য শু এবং টেফনাট মিলিত হন। গেব এবং নাট এর ভালোবাসা এত গভীরতা লাভ করে যে, তারা অবিচ্ছেদ্য সত্ত্বায় পরিণত হয়। আটুম এই ব্যাপারটা দেখে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং ওদের একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে ঠেলে দেন। গেবের উপরে নাটকে উঁচু করে তুলে ধরে, আটুম তাকে মহাবিশ্বের আচ্ছাদনের সাথে বেঁধে দেন। ইতিমধ্যেই গেবের ঔরসে গর্ভবতী হয়ে যান নাট। জন্ম দেন প্রথম পাঁচ দেবতার: ওসাইরিস, আইসিস, সেট, নেফথিস এবং হোরাস। এই আদি দেবতাদের থেকে অন্য সব দেবতাদের আগমন হয়েছে।

The Greenfield Papyrus
গ্রীন ফিল্ড প্যাপিরাস
The Trustees of the British Museum (Copyright)

সৃষ্টিকাহিনির একটি বিকল্প সংস্করণও পাওয়া যায়, যা প্রায় একই রকম। শুধু সেখানে দেবী নেইথকে পাওয়া যায়। যিনি মিশরীয় দেবতাদের মধ্যে একজন প্রাচীনতম দেবী। এই সংস্করণে, নিথ হলেন আদিম বিশৃঙ্খলা বা নুয়ের স্ত্রী। যিনি আটুম এবং অন্যান্য সমস্ত দেবতাদের জন্ম দেন। তবে এই পৌরাণিক কাহিনীতেও, হেকার অবস্থান নিথ এবং অন্যান্য দেবতাদের আগে থেকেই। যদিও মিশরের ইতিহাস জুড়ে বেশ কয়েকটি শিলালিপিতে নেইথকে ‘মাদার অফ দ্য গডস’ বা ‘মাদার অফ অল’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এটি বিশ্ব ইতিহাসে দেবীমাতার মূর্তির প্রথম উদাহরণগুলির মধ্যে একটি এই নেইথ। অন্য আর একটি সংস্করণে, নু (বিশৃঙ্খলা)কে নান নামে মূর্তরূপ প্রদান করা হয়েছে। ইনিই সমস্ত সৃষ্টির পিতা এবং মাতা, যিনি দেবতা এবং মহাবিশ্বের অন্য সবকিছুর জন্ম দিয়েছিলেন।

ইজিপ্টোলজিস্ট জেরাল্ডিন ​​পিঞ্চের মতে, দেবতাদের জন্ম হয়ে যাওয়ার সাথেই এবং সৃষ্টি গতি প্রাপ্ত হয়েছিল।

আদিম সেই অবস্থার নানান গুণ ছিল, যেমন এর অন্ধকার, যা পূর্ববর্তী চেতনা দ্বারা সমৃদ্ধ ছিল। এর থেকেই দেবতাদের একটি সমন্বয়ের জন্ম হয়। যা অষ্টক বা আট বা ওগডোড অফ হারমোপোলিস নামে পরিচিত। এই আট সত্ত্বাকে উভচর এবং সরীসৃপ হিসাবে কল্পনা করা হয়েছিল, অন্ধকার আদিম কর্দম জগতের প্রজনন সক্ষম প্রাণী। তারা ছিল সেই শক্তি যা স্রষ্টাকে বা এমনকি স্রষ্টার প্রাথমিক রূপ নির্মাণ করেছিল।

ওউরোবোরাসের প্রতীক, একটি সাপ তার নিজের লেজ গিলে খাচ্ছে, অনন্তকালের প্রতিনিধিত্ব করে। এর সূচনা হয়েছে সৃষ্টি এবং ঐশ্বরিক শক্তির সংযোগ থেকে। আটুম (রা)কে প্রারম্ভিক শিলালিপিতে একটি সাপ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে এবং পরে তিনি হলেন সাপ-রুপী-সূর্য-দেবতা (বা একটি সাপের দ্বারা সুরক্ষিত সূর্য দেবতা) যিনি অ্যাপোফিস সাপ রূপী প্রতীকী বিশৃঙ্খলার শক্তির সাথে যুদ্ধ করেন।

দেবতা ও দেবীর প্রকৃতি

সৃষ্টির সময় প্রাক আদিম সত্ত্বা বিভক্ত হওয়ার পরেও প্রাচীন মিশরের দেবতারা সম্প্রীতি ও ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন। জেরাল্ডিন ​​পিঞ্চ লিখেছেন, “সৃষ্টির আগে অজানা যুগের দিকে ইঙ্গিত করা লেখাগুলি, ওই সময়টাকে 'দুটি বিশেষ বিষয়ের বিকশিত হওয়ার আগের সময় হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে৷ মহাজগত তখনও পৃথিবী এবং আকাশ, আলো এবং অন্ধকার, পুরুষ এবং মহিলা বা জীবন এবং মৃত্যুর মতো বিপরীতধর্মী জোড়ায় বিভক্ত হয়নি৷" শুরুতে, সব এক ছিল । তারপর, বেন-বেনের উত্থান হয় এবং দেবতাদের জন্মের সাথেই বহুত্বর আগমন ঘটে সৃষ্টির জগতে। এক হয়ে ওঠে অনেক।

মিশরীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এই 'অনেক'-এর ভারসাম্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। সম্প্রীতির এই নীতি পরিচিত মা’আত নামে। মা’আত ছিল মিশরীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় মূল্যমান। যা মানুষের জীবনের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করত। কীভাবে তারা তাদের শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করবে, জীবন পথে নিজেদের পরিচালনা করবে, এমনকি তাদের পরকাল বিষয়ক ভাবনাচিন্তা ক্ষেত্রেও এই নীতি বিশেষ স্থান গ্রহন করেছিল। আর যে শক্তি দেবতাদের তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে, মানুষকে তাদের দেবতাদের কাছে পৌঁছানোর অনুমতি দেয় এবং মা’আতকে টিকিয়ে রাখে তার নাম হেকা। হেকা, এই দেবতা বিষয়ে ‘কফিন টেক্সট’ বা শবাধারে লিখিত শব্দাবলীতে যা পাওয়া যায় তার ভাষ্য অনুসারে, অন্য কোনও দেবতার আগে থেকে এঁর অস্তিত্ব ছিল।

মেসোপটেমিয়ার জনগণের মতো, [কিছু পণ্ডিত-গবেষকে দাবি করেছেন যে, মিশরীয়রা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এদের কাছ থেকেই ধার করেছিল] মিশরের মানুষেরা বিশ্বাস করত যে, তারা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং বিশৃঙ্খলার শক্তিকে উপেক্ষা করার ক্ষেত্রে দেবতার সঙ্গী বা অংশীদার। এই ধারণাটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার গল্পটি হল, ‘দ্য ওভারথ্রোয়িং অফ অ্যাপোফিস’ । যার সূত্রে একটা নিজস্ব আচারপ্রথা তৈরি হয়েছে। অ্যাপোফিস ছিল আদিম সাপ। যে প্রতি রাতে, অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ভোরের দিকে যাওয়ার সময় রা-এর সূর্য বজরা আক্রমণ করত। বিভিন্ন দেব-দেবীরা অ্যাপোফিসের হাত থেকে এই বজরা রক্ষা করার জন্য রা-কে সাহায্য করত। সাথে মৃতদের আত্মারাও এই সাপকে তাড়াতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হয়েছে। এই গল্পের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রগুলির মধ্যে একটিতে দেখা মেলে দেবতা সেটের। যিনি ওসাইরিস মিথের খলনায়ক হিসাবে পরিচিত হওয়ার আগে, সাপটিকে বর্শা দিয়ে আঘাত করে চিরন্তন আলোকে রক্ষা করছেন।

Apophis Defeated
অ্যাপোফিসের পরাজয়
kairoinfo4u (CC BY-NC-SA)

এই গল্প সূত্রে যে আচারপ্রথার জন্ম হয়েছিল তা এরকম। কাঠ বা মোম দিয়ে অ্যাপোফিসের মূর্তি বানিয়ে সেটাকে আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করা। মনে করা হত, মৃতদের আত্মা এবং সকালের সূর্য আনতে সাহায্যকারী রা এর বজরায় ভ্রমণকারী দেবতাদের এর দ্বারা সাহায্য করা হচ্ছে। মেঘলা দিন হলেই প্রাচীন মিশরীয়রা আতঙ্কিত হত। এটাকে তারা একটা অশুভ সংকেত হিসাবে মনে করত। ভাবত অ্যাপোফিস সাপ দেবতা রা-কে পরাজিত করছে এভাবে। একইভাবে সূর্যগ্রহণও তাদের কাছে ছিল এক বিশাল মাপের ভয়ের উৎস। বিশ্বাস অনুসারে, মিশরীয়রা, আচার-অনুষ্ঠান এবং তাদের দেবতাদের উদ্দেশে ভক্তিশ্রদ্ধা প্রদর্শনের মাধ্যমে, প্রতিদিন সকালে সূর্যকে আবার উদিত হতে সাহায্য করত। প্রতিটি দিনের আগমনের এই লড়াইকে তারা শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার শক্তির মধ্যে লড়াই হিসাবে দেখত। জেরাল্ডিন ​​পিঞ্চ লিখেছেন:

যখন আটুমের মতো সৃষ্টিকর্তাকে সাপ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়, তখন একে সাধারণত বিশৃঙ্খলার ইতিবাচক দিকের একটি শক্তি হিসাবেই উপস্থাপিত করে। নিশ্চিতভাবেই মহা সর্প অ্যাপোফিস তারই নেতিবাচক প্রতিরূপ। অ্যাপোফিস বিশৃঙ্খলার ধ্বংসাত্মক দিকটাকে উপস্থাপন করেছিল। যার মূল লক্ষ্য ক্রমাগত আক্রমণ দ্বারা সমস্ত একক সত্ত্বাকে নিজের ভিতর সমাহিত করা এবং আবার সেই প্রাথমিক আদিম অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। সুতরাং, সৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে থেকেই, এ জগতে নিজস্ব ধ্বংসের উপাদান ছিল ।

এই ধ্বংস দেব-দেবীদেরও গ্রাস করতে বা প্রভাবিত করতে সক্ষম । অনেকের পুনরায় একের সাথে মিলে যাওয়া, বা এক সম্পূর্ণতার অবস্থা ফিরে আসাকে কোনও না কোনও কারণে অনিবার্য বলে মনে করা হয়েছিল। পণ্ডিত-গবেষক আর.এইচ. উইলকিনসন জানিয়েছেন কীভাবে ‘কিছু সংখ্যক মিশরীয় গ্রন্থ দেখায় যে, দেবতাদেরকে স্বাভাবিক অর্থে নশ্বর বলে মনে করা হত না, তবুও তারা মারা যেতে পারে’ । এই বিশ্বাসটি ভারসাম্য ও সম্প্রীতির মিশরীয় মূল্যমান থেকেই এসেছে বলে মনে হয়। যেহেতু মহাবিশ্বের বহুত্ব এক থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, এটি একদিন তার আসল অবস্থায় ফিরে যাবে। ওসাইরিসের মতো একজন দেবতাকে হত্যা করা যেতে পারে এবং তারপরে উনি জীবিত রূপ ফিরে পেতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল কেবলমাত্রই একটি সাময়িক অস্থায়ী পরিস্থিতি; একদিন, সমস্ত কিছুই আদিম বিশৃঙ্খলার জগতে ফিরে যাবে - যেখান থেকে এর জন্ম হয়েছিল। উইলকিনসন লিখেছেন:

ঐশ্বরিক মৃত্যুর নীতি প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত মিশরীয় দেবতার জন্য প্রযোজ্য। একটি লেখনী যা কমপক্ষে নতুন সাম্রাজ্যের সময়কালের বলে মনে করা হয়, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে, দেবতা থথ মানুষ এবং দেবতাদের একইভাবে নির্দিষ্ট আয়ু বরাদ্দ করেন। ‘বুক অফ দ্য ডেড’ এর ১৫৪ নম্বর মন্ত্র দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে যে, মৃত্যু (আক্ষরিক অর্থে, 'ক্ষয়' এবং 'অদৃশ্য হয়ে যাওয়া') অপেক্ষা করছে 'প্রত্যেক দেবতা ও দেবীর জন্য'...এবং শুধুমাত্র সেই উপাদানগুলোই বর্তমান থাকবে যেগুলো থেকে আদিম জগতের উদ্ভব হয়েছিল।

একত্বের এই ধারণা, এক অভেদ্য সমগ্রের স্বীকৃতি, মিশরীয় সংস্কৃতিতে একে তাদের নিজস্ব ভাবনায় মূল্যায়ন করা হয়নি। চীন বা হিন্দু সংস্কৃতিতে এই ভাবনার একটা নির্দিষ্ট ইতিবাচক দিক আছে। কিন্তু মিশরের মানুষের কাছে এর অর্থ ছিল ভয় । অভেদ্য একত্বে ফিরে যাওয়ার অর্থ হল একজনের ব্যক্তিগত পরিচয় হারানো, একজনের স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া, জীবনে একজন যা কিছু অর্জন করেছে সেইসব হারিয়ে ফেলা এবং প্রিয়জনদের হারানো; এই চিন্তা প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে অসহনীয় ছিল। পরকালে গিয়ে, 'নরকে' স্থান পাওয়ার পরিবর্তে, একটি আত্মার সাথে ঘটতে পারে এমন সবচেয়ে খারাপ বিষয় তাদের কাছে ছিল, স্বর্গের জন্য অযোগ্য বলে বিচার লাভ করা। মৃত ব্যক্তির আত্মার হৃদয়কে মৃত্যুর পর সত্যের সাদা পালকের বিপরীতে ওজন করা হত। যদি হৃদয় পালকের চেয়ে ভারী বলে প্রতিভাত হত তাহলে সেটা নিচে মেঝেতে ফেলে দেওয়া হত। আম্মুত দানব সেটাকে খেয়ে নিত।

হৃদয়কে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এবং আত্মার কেন্দ্র হিসাবে বিশ্বাস করা হত এবং এটাকে যদি ওই দানব খেয়ে নেয়, তার অর্থ আত্মার অস্তিত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়া। এই অস্তিত্বহীনতা মিশরীয়দের কাছে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল। বানসন লিখেছেন, ‘মিশরীয়রা পরবর্তী জীবনে চিরন্তন অন্ধকার এবং অচেতনতাকে ভয় করত। কারণ, উভয় অবস্থাই মহাবিশ্বে আলোর সুশৃঙ্খল অবস্থান এবং গতিবিধিকে অস্বীকার করে’। যে ‘আলোর সুশৃঙ্খল অবস্থান এবং গতিবিধি’ আসলে জীবনের প্রতীক স্বরুপ। পৃথিবীতে একজনের জীবনের নিখুঁত অবিকল প্রতিরূপ দেখতে পাওয়া যায় মৃত্যু পরবর্তী জগতেও, এই মিশরীয় বিশ্বাস বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ লাভ করেছিল এই অনস্তিত্বের বা নিজেকে হারানোর ভয়ের কারণে। মিশরীয় বিশ্বাস অনুসারে, অনেক অনেক লক্ষ বছর পর দেবতারা শেষ পর্যন্ত মারা যাবেন, মানুষেরাও তাদের সাথে মারা যাবে এবং সমস্ত মানব ইতিহাস অর্থহীন হয়ে যাবে।

মিশরের দেবতা ও দেবদেবীর মৃত্যু

প্রাচীন মিশরের দেব-দেবীরা শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিল এবং তার জন্য লক্ষ লক্ষ বছর সময়ও লাগেনি। খ্রিস্টধর্মের উত্থানের সাথেই প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মীয় অনুশীলনের সমাপ্তি ঘটে। এমন জগত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় যা জাদু দ্বারা আচ্ছন্ন অবস্থায় টিকে ছিল। ঈশ্বর এরপর থেকে স্বর্গে বাস করতে শুরু করেন। পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থানকারি একক সত্ত্বা রূপে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এখন আর বহুবিধ দেবতা এবং আত্মা[স্পিরিট]রা তাদের সাথে বসবাস করে না। যদিও এই নতুন ঈশ্বর তাঁর পুত্র যীশু খ্রীষ্টের মতো মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে উপস্থিত হতে পারেন। তবুও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থগুলি তাকে "অগম্য আলোর জগতে বসবাস করা" হিসাবে বর্ণনা করে (প্রথম টিমোথি ৬:১৬)। ঐশ্বরিক সর্পের চিত্রটি ইতিমধ্যেই ইহুদি লেখকেরা নিজেদের ভাবনার দ্বারা রূপান্তরিত করে দিয়েছেন। সে সাপ স্বর্গ থেকে মানুষের পতনের প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে (জেনেসিস ৩)। পৃথিবী নিজেই, বন্ধুত্বপূর্ণ দেবতাদের শক্তিরূপ আত্মার সাথে আবদ্ধ হওয়া থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। একে এখন খারাপ স্থান বলে মনে করা হয়। খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ অনুসারে এই স্থান ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ শয়তানের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে (রোমানস ৫:২, ২য় করিন্থিয়ানস ৪:৪, গালাশিয়ান ১:৪, প্রথম জন ৫:১৯ ইত্যাদি)। ৫ম শতাব্দীর সূচনা থেকেই মধ্যে মিশরীয় দেবতাদের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে এবং ৭ম শতাব্দীতে তারা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। তবে উইলকিনসনের লেখা অনুসারে, তবে তারা সহজে রাস্তা ছাড়েননি:

৩৮৩ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য জুড়ে পৌত্তলিক মন্দিরগুলি সম্রাট থিওডোসিয়াসের আদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়। জারি হয় আরও কিছু ডিক্রি। ৩৯১ খ্রিস্টাব্দে থিওডোসিয়াস দ্বারা এবং ৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় ভ্যালেনটিনিয়ান দ্বারা ঘোষিত আদেশ, পৌত্তলিক ধর্মীয় কাঠামোর প্রকৃতপক্ষেই ধ্বংসের অনুমোদন দেয়। অন্য কাজে ব্যবহারের দাবি তুলে শীঘ্রই মিশরের বেশিরভাগ মন্দির দখল করা হয়। অথবা ঈর্ষান্বিত উদ্যোগী খ্রিস্টানদের দ্বারা সক্রিয়ভাবে ধ্বংস করা হয়, এবং প্রাচীন দেবতারা মূলত হারিয়ে যেতে শুরু করেন।

উইলকিনসন এবং অন্যান্য গবেষকেরার উল্লেখ করেছেন কীভাবে প্রাচীন মিশরীয় বিশ্বাসগুলি খ্রিস্টধর্ম এবং তারপরে ইসলাম দ্বারা ধ্বংস করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বেঁচে ছিল। ‘দ্য মিথ অফ ওসাইরিস’ এর কেন্দ্রীয় দেবতা চরিত্র যিনি মরার পরেও পুনরায় বেঁচে ওঠেন, আইসিস কাল্টের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। এই কাল্ট ভাবনা ৩৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মিশর জয় করার পরে গ্রীসে পৌঁছে যায়। গ্রীস থেকে, আইসিসের এই উপাসনা পদ্ধতি রোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যেখানে খ্রিস্টধর্মের উত্থানের আগে এই ধর্মাচারণ রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্মের উথানের আগে অত্যন্ত জনপ্রিয় ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়। পরে সবচেয়ে একগুঁয়ে প্রতিপক্ষ হিসাবেও নিজের পরিচয় বজায় রাখে। প্রাচীনকালের সেই বিশ্বে পম্পেই থেকে এশিয়া মাইনর, গোটা ইউরোপ জুড়ে এবং ব্রিটেনে পর্যন্ত আইসিসের মন্দিরগুলি স্থাপিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মৃত ও পুনরুজ্জীবিত ঈশ্বরের ধারণা, যা ওসাইরিস মিথের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিষ্ঠিত ছিল তা রূপান্তরিত হয়ে এখন ঈশ্বরের পুত্র, যীশু খ্রীষ্টের কাহিনিতে পরিণত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথেই, আইসিসের উপাধিগুলি ভার্জিন মেরির জন্য ব্যবহার হতে থাকে। যেমন ‘ঈশ্বরের মা’ এবং ‘স্বর্গের রানী’। এর একটাই কারণ, নতুন ধর্ম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরনো ধার্মিক বিশ্বাসের শক্তি বা নীতিকে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিল। ‘অ্যাবাইডোস ট্রায়াড’ নামে পরিচিত ওসাইরিস, আইসিস এবং হোরাসের ত্রিত্ব শক্তি নতুন ধর্মে রূপান্তরিত হয়ে গেল পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার ত্রিত্ব রূপে। এভাবেই আধিপত্য অর্জনের জন্য নতুন ধর্মের বিশ্বাসীদের পুরনো বিশ্বাসকে ধ্বংস করতে হয়েছিল বা বলা ভাল নতুন রুপ দিতে হয়েছিল।

মিশরের ফিলাতে আইসিসের মন্দিরটিকে সেই সময়ের টিকে থাকা শেষ পৌত্তলিক মন্দির হিসাবে বিবেচনা করা হয়। রেকর্ড অনুসারে, ৪৫২ খ্রিষ্টাব্দে তীর্থযাত্রীরা ফিলার মন্দির পরিদর্শন করেছিলেন এবং আইসিসের মূর্তিটিকে ওখান থেকে সরিয়ে ফেলেন। নুবিয়ার অন্যান্য দেবতাদের সাথে একসাথে রাখার জন্য সম্মানের সাথে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন (উইলকিনসন, ২৩)। ৫২৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের সময় নাগাদ সমস্ত পৌত্তলিক বিশ্বাসকে দমন করা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে নতুন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অনেক ঘটনাই ঘটেছিল কিন্তু পুরনো দেবতাদের ব্যাপকভাবে উপাসনা তখন কেবলমাত্র স্মৃতির ধূসর ছবি। উইলকিনসন লিখেছেন:

৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে আরব সেনাবাহিনী মিশর দখল করার পর দাবি করেছিল, তারা কেবল খ্রিস্টানদের এবং হারিয়ে যাওয়া এক সভ্যতার হারিয়ে যেতে থাকা প্রাচীন দেবতাদের উপাসনাকারী উত্তরাধিকারীদের খুঁজে পেয়েছিল। যারা ৩০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সভ্যতার অন্যতম সেরা কেন্দ্র রূপে অবস্থান করেছিল।

তবে এটা বলাই যেতে পারে, মিশরের দেব-দেবীরা কখনোই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হবে না। তারা নতুন একেশ্বরবাদী মতাদর্শ ইহুদি, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলামের ভিতর মিলে মিশে গেছে। ইসলাম ধর্মের প্রধান পাঁচ নীতির ভিতর আছে প্রার্থনা, তীর্থযাত্রা, উপবাস এবং ভিক্ষা প্রদান। এ সবই সহস্রাব্দ আগে প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের দেবতার উপাসনায় অনুশীলন করত। হেকার ধারণা, এক চিরন্তন, অদৃশ্য শক্তি যা সৃষ্টি ও চলমান জীবনকে শক্তিশালী করে। যে ভাবনাকে গ্রীক এবং রোমান বিদ্বান এবং নব্য-প্লেটোনিস্টরা যথাক্রমে ‘লোগোস’ এবং ‘নউস’ হিসাবে বিকশিত করে। এই উভয় দর্শনই খ্রিস্টধর্মের বিকাশকে প্রভাবিত করেছিল।

আধুনিক দিনে, মানুষ প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাসকে আদিম, বহু ঈশ্বরবাদী বিশ্বাস হিসাবে উল্লেখ করে। মিশরীয় দেবতাদের ৩০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উপাসনা করা হয়েছিল এবং একমাত্র ধর্মীয়-ভাবনার সংঘর্ষটি ঘটেছিল আখেনাতেনের রাজত্বকালে ঘটেছিল (১৩৫৩-১৩৩৬ খ্রিস্টপূর্ব) বলে নথিভুক্ত করা আছে। যখন রাজা সর্বোচ্চ দেবতা আটেনের প্রতি একেশ্বরবাদী শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার জন্য জোর দিয়েছিলেন। যদিও এর মূল কারণ ছিল আমুনের পুরোহিতদের ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য সম্ভাব্য একটি রাজনৈতিক কৌশল। মিশরের ইতিহাসের বৃহত্তর সময়কালে, ধর্মের ভিত্তিতে সেই অর্থে কোনও যুদ্ধ হয়নি। এর অন্যতম কারণ, তাহলে নিজেদেরকে দেবতাদের সঙ্গী মনে করা মানুষকে, দেবতাদের দেওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধের বিরুদ্ধে যেতে হত: যার নাম ‘সম্প্রীতি’।

বিজ্ঞাপন সরান
বিজ্ঞাপন

গ্রন্থ-পঁজী

ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি এনসাইক্লোপিডিয়া একটি অ্যামাজন সহযোগী এবং যোগ্য বই ক্রয়ের উপর একটি কমিশন উপার্জন করে।

অনুবাদক সম্পর্কে

Pratim Das
I am an Artist. My goal - paint all the Indian Sub-continental bird species. already done 1200+ species. Hobby is writing in Bengali [My mother tongue] and also like to do translation from English To Bengali. Some books published from India and Bangladesh.

লেখক সম্পর্কে

Joshua J. Mark
জোসুয়া যে মার্ক একজন 'ফ্রিল্যান্স' লেখক এবং নিউ ইয়র্ক, মারিস্ট কলেজের প্রাক্তণ পার্ট-টাইম প্রফেসর অফ ফিলজফি। নিবাস গ্রীস এবং জার্মানি। ইজিপ্ট ভ্রমণ করেছেন একাধিকবার। কলেজে উনি ইতিহাস, লেখালিখি, সাহিত্য এবং দর্শন বিষয়ে শিক্ষাদান করেছেন।

এই কাজটি উদ্ধৃত করুন

এপিএ স্টাইল

Mark, J. J. (2016, April 17). প্রাচীন মিশরের দেব-দেবী - সংক্ষিপ্ত ইতিহাস [Gods & Goddesses of Ancient Egypt - A Brief History]. (P. Das, অনুবাদক). World History Encyclopedia. থেকে প্রাপ্ত https://www.worldhistory.org/trans/bn/2-884/

শিকাগো স্টাইল

Mark, Joshua J.. "প্রাচীন মিশরের দেব-দেবী - সংক্ষিপ্ত ইতিহাস." অনুবাদ করেছেন Pratim Das. World History Encyclopedia. সর্বশেষ পরিবর্তিত April 17, 2016. https://www.worldhistory.org/trans/bn/2-884/.

এমএলএ স্টাইল

Mark, Joshua J.. "প্রাচীন মিশরের দেব-দেবী - সংক্ষিপ্ত ইতিহাস." অনুবাদ করেছেন Pratim Das. World History Encyclopedia. World History Encyclopedia, 17 Apr 2016. ওয়েব. 26 Dec 2024.