প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে পরিচিত ভূতের গল্পটা, এক কথায় ‘আ ঘোস্ট স্টোরি’ বা ‘একটা ভূতের গল্প’ হিসাবে পরিচিত। তবে কখনও কখনও গল্পটাকে ‘খোনসেমহাব এবং ভূত’ হিসাবেও উল্লেখ করা হয়। গল্পটার সময়কাল মিশরের নতুন সাম্রাজ্য সময়কালের শেষের দিকের (আনুমানিক ১৫৭০-১০৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং বিশেষভাব বললে, ‘রামেসাইড পিরিয়ড’ (১১৮৬-১০৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।
এ গল্প পাওয়া গেছে অস্ট্রাকা (লেখা সহ মৃৎপাত্র)র ভাঙ্গা টুকরোতে। যাকে জর্জেস পোসেনার (১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ) এবং জার্গেন ভন বেকেরথ (১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ) এর মতো পণ্ডিতেরা আরও পুরনো সময়ের, মিশরের মধ্যকালীন সাম্রাজ্য (২০৪০-১৭৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), গল্পের অনুলিপি বলে দাবি করেছেন। এই যুক্তি অবশ্য অর্থবহ। কারণ মিশরে ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে পরকালকে এক স্বর্গ হিসাবে দেখানো নিয়ে প্রায়শই সেই যুগের পাঠ্যগুলিতে প্রশ্ন করা হয়েছিল (যেমন ‘দ্য লে অফ দ্য হার্পার’ কিংবা ‘আ ডিস্পিউট বিটুইন আ ম্যান অ্যান্ড হিজ সোল’), এবং খোনসেমহাবও এই একই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই ভূতের সাথে কথোপকথন চালিয়েছে।
‘আ ঘোস্ট স্টোরি’তে আমরা পাই আমুনের মহাযাজক বা ‘হাই প্রিস্ট’ খোনসেমহাবের গল্প। যিনি এমন এক অস্থিরমনা ভূতের মুখোমুখি হয়েছেন যার সমাধিস্থল নষ্ট হয়ে গেছে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ সময়ের ভিতর থিবসের নিকটবর্তী ‘দেইর এল-মদিনা’র নেক্রোপোলিসের আশপাশে থেকে আবিষ্কৃত চারটে অস্ট্রাকাতে গল্পটা বিদ্যমান। ওই অস্ট্রাকাগুলো বর্তমানে প্যারিস, ফ্লোরেন্স, ভিয়েনা এবং তুরিনের জাদুঘরে রাখা আছে। গল্পের সূত্রে ওদের একের সাথে অন্য একটা অংশের সম্পর্ক বর্তমান। গল্পের উপসংহার, দুর্ভাগ্যবশত, এখনও পাওয়া যায়নি।
বিশ্বজুড়ে প্রচলিত ভূতের গল্পের মতোই, খোনসেমহাব গল্প দুটো ভাবনায় বিভক্ত: বিনোদন এবং সাংস্কৃতিক শিক্ষা। শ্রোতারা একই সাথে এ গল্প শুনে যেমন বিনোদন লাভ করবেন, তার সাথেই মৃতদের শেষ বিশ্রামের স্থানগুলির যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে তাদের সম্মান করার গুরুত্বও উপলব্ধি করতে পারবেন।
গল্প
পাঠ্যের ব্যাখ্যা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেন যে, এটা একজন প্রত্যক্ষ বক্তার বলা বর্ণনা, যিনি থিবসের নেক্রোপোলিসে রাত কাটান এবং এক ক্ষুব্ধ আত্মার মুখোমুখি হন। এই নামহীন কথক এরপর মহাযাজকের কাছে যায় তার সাহায্য চাইতে। খোনসেমহাব ওই আত্মাকে জাগিয়ে তোলেন কথা বলার জন্য। প্রথম-ব্যক্তি রূপে কোনও এক বর্ণনাকারীর ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে প্রথম লাইনগুলোর কেবলমাত্র একটার উপর নির্ভর করে। অন্যান্য পণ্ডিত-গবেষকেরা দাবি করেন যে, এটা আসলে এক তৃতীয়-ব্যক্তির বলা বর্ণনা। যে জানায় কীভাবে খোনসেমহাব নেক্রোপোলিসে এক আত্মার মুখোমুখি হয়েছিল এবং সেই আত্মাকে শান্তি প্রদান করার ক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল।
গল্পের শুরুটাও উপসংহারের মতোই টুকরো-টাকরা অবস্থায় পাওয়া গেছে। এর থেকেই বোধগম্য হয় যে, কীভাবে শুরুতে উল্লিখিত ‘আমি’ শব্দটা প্রথম ব্যক্তি রূপে কোনও বক্তার বর্ণনা নির্দেশ করে। তবে গল্পটা কোনও তৃতীয়-ব্যক্তির বর্ণনা হিসাবে বেশি অর্থপূর্ণভাবে প্রতিভাত হয়। প্রথম-ব্যক্তিরূপ কথকের উপস্থিতি শুরুর লাইনগুলোর পরে না থাকায়, এই লাইনগুলো আসলে খোনসেমহাবের দ্বারা বলা সংলাপ হতেই পারে। কিছু অনুবাদে, শুরুর লাইনের ওই ‘আমি’ সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। ওগুলোকে খোনসেমহাবের সংলাপ হিসাবে দেখানোতে অবশ্য গল্পের ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব পড়েনি।
যাই হোক, এর পরের দুই লাইন এক ধরণের যাত্রা বা ভ্রমণের সাথে সম্পর্কিত, খোনসেমহাব তার বাড়িতে ফিরে আসেন। আত্মাকে আহ্বান করে তার কাছে আসার এবং নিজের পরিচয় পেশ করার। সাথেই একটা নতুন সমাধি তৈরি করার ক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। যেখানে "সব ধরণের ভাল জিনিস রাখা হবে"। এখান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মহাযাজক ইতিমধ্যে আত্মার কষ্ট সম্পর্কে সচেতন। ভূতটা তার কাছে এসে জানায়, তার নাম নেবুসেমেখ। খোনসেমহাব আত্মাটাকে জিজ্ঞাসা করেন, যে তাকে ঠিক কী বিষয় কষ্ট দিচ্ছে। নেবুসেমেখ উত্তর দেয় যে, তার সমাধি ভেঙে পড়ে গেছে। এখন কারও মনেও নেই যে তাকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছিল। ফলে যথাযথভাবে তার প্রাপ্য তারজন্য আর কেউ আনে না। নেবুসেমেখ জানাচ্ছে যে, "শীতের বাতাসে উন্মোচিত হয়ে আছে তার দেহ, খাবার না পেয়ে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত" এবং ভয় পাচ্ছে যে শীঘ্রই তার অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়ে যাবে। অথবা, তার কথা অনুসারে, "প্লাবনের ধাক্কা খাওয়ার মতো সব কিছু এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে যাবে " এবং হারিয়ে যাবে কারণ তার আত্মার অবস্থান করার মতো কোনও ঘর নেই।
খোনসেমহাব আত্মার পাশে বসে তার দুঃখে অশ্রু বিসর্জন করে। আত্মাটা এরপর জানায়, জীবিত থাকা অবস্থায় সে কে ছিল:
আমি যখন পৃথিবীতে বেঁচে ছিলাম তখন আমি রাজা মেন্টুহোটেপের কোষাগারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলাম। সাথেই সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ছিলাম। সাধারণ মানুষের নেতা এবং দেবতাদের ছত্রচ্ছায়ায় ছিলাম। উচ্চ ও নিম্ন মিশরের রাজা মেন্টুহোটেপের সময়কালে তার রাজত্বের ১৪ তম বছরের গ্রীষ্মকালে, আমার চিরবিশ্রামের সূচনা হয়। উনি আমাকে আমার চারটে ‘ক্যানোপিক জার’ এবং ‘অ্যালাবাস্টারের সারকোফ্যাগাস দিয়েছিলেন। সমাজে আমার অবস্থানে থাকা একজনের জন্য যা যা করা হয় তা উনি আমার জন্য করেছিলেন। উনি আমার জন্য যে সমাধিতে শুয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তার দৈর্ঘ্য দশ হাত। যার নীচের মাটি খারাপ হয়ে যায় এবং ধ্বসে যায়। এখন ওখানে বাতাস বয়ে যায়, জিভ জড়িয়ে আসে। এখন যেহেতু আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন 'আমি আপনার জন্য নতুন করে একটি সমাধি প্রস্তুত করব' তাই জানাই যে, এরকম প্রতিশ্রুতি আমার সাথে ইতিমধ্যে চারবার করা হয়েছে, বলা হয়েছিল এরকমটাই করা হবে। তাই আপনি এইমাত্র আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিলেন, সেটা যাতে ঠিকঠাক কার্যকর হতে পারে তার জন্য আমি কী করব? (সিম্পসন ১১৩-১১৪)
খোনসেমহাব আত্মাটিকে আশ্বস্ত করেন, উনি তার জন্য যা কিছু করতে পারেন সেটা করবেন। বলেন, "অনুগ্রহ করে আমাকে জানান সবচেয়ে ভালো কী চাইছেন যেটা আপনার জন্য করার উপযুক্ত হবে এবং আমি অবশ্যই এটি আপনার জন্য করব।" কিন্তু আত্মা তাতে আশ্বস্ত হতে পারে না। নেবুসেমেখ বলে, "আপনি যা করবেন তাতে কি লাভ হবে? একটি গাছ যদি সূর্যের আলোর সংস্পর্শে না আসে, তবে তাতে পাতা জন্মায় না," অর্থাৎ সে আশা করতে পারছে না যে, মাহাযাজক তাকে একবারে আগের মতোই একটা পরকালের ঘর বানিয়ে দিতে সক্ষম হবেন। যেহেতু খোনেসেমহাবের ওই পরিমাণ সম্পদ নেই। সূর্যের আলো ছাড়া যেমন একটা গাছ বড় হয়ে উঠতে পারে না, তেমনই শুধু প্রতিশ্রুতি ও শুভেচ্ছার ভিত্তিতে তার সমাধি পুনর্নির্মিত হতে পারে না। মহাযাজক তাকে ইতিমধ্যেই আশ্বস্ত করেছেন যে, যদি তিনি তাকে একটা নতুন সমাধি তৈরি করে দিতে না পারেন, তাহলে তারজন্য পাঁচজন চাকর এবং পাঁচজন দাসী বহাল করবেন। যারা তাকে প্রতিদিন খাবার এবং জল দিয়ে যাবে। কিন্তু তাতেও ওই আত্মা সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
নেবুসেমেখ এরপর অদৃশ্য হয়ে যায়। খোনসেমহাব তার প্রতিশ্রুতি ভুলে যাননি। উনি ধ্বংস হয়ে যাওয়া সমাধি অনুসন্ধানের জন্য লোক পাঠান এবং তারা ওটাকে ‘দেইর এল-বাহরিতে রাজার পায়ে হেঁটে চলার পথ থেকে পঁচিশ কিউবিট দূরে" খুঁজে পায়। ওরা তাদের মালিককে এটা জানানোর জন্য ফিরে আসে। খোনসেমহাব এই খবরে খুশি হন এবং সবাইকে সাধুবাদ জানান। পরে, তার ভাবনা সম্পর্কে বলার জন্য একজন কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠান। গল্পটি শেষ হয় এই লাইন দিয়ে "ওইদিন সন্ধ্যায় উনি ফিরে এলেন নে-তে রাত কাটনোর জন্য, এবং উনি..." কিন্তু এরপর গল্পের বাকি অংশ পাওয়া যায়নি। লাইনের ‘নে। থিবসের নেক্রোপলিসকে নির্দেশ করে এবং মনে করা হয় যে খোনসেমহাব গল্পের শুরুতে যে স্থানে ছিলেন সেখানে ফিরে গিয়ে নেবুসেমেখকে বলেন যে, শীঘ্রই তার একটি নতুন বাসস্থান তৈরি হবে।
মূল লেখনী পাঠ
এখানে গল্পের মধ্যে, ‘l.p.h’ লেখা দেখতে পাবেন। রাজার নামের পরে। এটা মিশরীয় শব্দগুচ্ছ ‘Ankh wedja seneb’ এর ইংরেজি সমতুল। যার অর্থ ‘জীবন, সমৃদ্ধি, স্বাস্থ্য’, যা প্রাচীন শিলালিপিগুলোতে রাজকীয় নামের পরে দেখতে পাওয়া যায়। নিম্নলিখিত পাঠটা বেকের্যাথের অনুবাদ অনুসরণ করে ডব্লু কে সিম্পসনের লেখা ‘দ্যা লিটারেচর অফ অ্যান্সিয়েন্ট ইজিপ্ট: অ্যান অ্যান্থলজি ফর স্টোরিজ, ইন্সট্রাকশন, স্টেলা, অটোবায়োগ্রাফিজ অ্যান্ড পোয়েট্রি থেকে নেওয়া হয়েছে।
এখানে গল্পের শুরুতে প্রথম-ব্যক্তি রূপে বর্ণনাকারীর লাইনটা বাদ দেওয়া আছে, "এখন যখন আমি পশ্চিমের দিকে তাকাচ্ছিলাম, সে ছাদের উপর উঠে গেল" যা সাধারণ অনুবাদে নীচের লেখার তৃতীয় লাইনের নিচে পাওয়া যাবে। গল্পে অনেক অনুপস্থিত শব্দ আছে। এছাড়াও বন্ধনীর ভিতর সম্ভাব্য শব্দ/বাক্যগুলি নির্দেশ করছে যা মূলে অস্পষ্ট ছিল। পাঠ অনুসারে:
তার আচরণ [... অনুযায়ী]... তারপর যেভাবে সে কাজটা করেছিল... সে নৌকায় চেপে জলপথ পার হয়ে নিজের বাড়িতে পৌঁছল। তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে [যা করবেন ভেবে] বললেন, "আমি যখন পশ্চিম দিকে যাব তখন আমি তাকে সব ধরণের ভাল জিনিস সরবরাহ করব।" ছাদে উঠে গেলেন, আকাশের দেবতাদের এবং দক্ষিণ, উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বদিকের পৃথিবীর দেবতাদের, এবং পাতালের দেবতাদের আহ্বান জানিয়ে বললেন: "আমার কাছে সেই বিশেষ আত্মাকে পাঠান।" অতএব সে এল এবং তাকে বলল: "আমিই সেই... যে তার সমাধির পাশে রাতে ঘুমাতে এসেছিল।" আমুনের মহাযাজক খোনসেমহাব তাকে বললেন: "অনুগ্রহ করে আমাকে আপনার নাম, আপনার পিতার নাম এবং আপনার মায়ের নাম বলুন, যাতে আমি তাদের সম্মান জানাতে পারি এবং তাদের জন্য যা যা করা সম্ভব তা করতে পারি।" প্রসন্ন আত্মা তখন তাকে বলল: "নেবুসেমেখ আমার নাম, আনখমেন আমার বাবার নাম এবং তামশাস আমার মায়ের নাম।"
এবার দেবতাদের রাজা, আমুন-রের মহাযাজক, খোনসেমহাব তাকে বললেন; "আপনি কি চান তা আমাকে বলুন, যাতে আমি আপনার জন্য সেটা করতে পারি। আমি আপনার জন্য নতুন করে একটা সমাধি নির্মাণ করব, বানিয়ে দেব সোনা এবং জিজিফাস-কাঠের শবাধার। আপনি [সেখানে বিশ্রাম করবেন]। আমি আপনার জন্য সেটাই করব যা আপনার অবস্থানে থাকা একজনের জন্য করা হয়।"
শ্রদ্ধেয় আত্মা তখন তাকে বলেছিল: "এমন কাউকে অতিরিক্ত উত্তপ্ত করা যায় না যে শীতের বাতাসের সংস্পর্শে আসে, খাবার ছাড়াই ক্ষুধার্ত হয়... প্লাবনের মতো উপচে ঠেলে বের হয়ে আসা আমার ইচ্ছা নয়, না ... আমার সমাধিস্থল দেখার ইচ্ছেও নেই ... আমি ওটার কাছে পৌঁছাতে পারব না। আমাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল..."
এখন [তাঁর] কথা শেষ হওয়ার পর, আমুন-রে, দেবতাদের রাজার মহাযাজক, খোনসেমহাব, তাঁর পাশে বসে ব্যাথিত মুখে অশ্রু বিসর্জন করলেন। তারপর আত্মাকে সম্বোধন করে বললেন, "না খেয়ে বা কিছু পান না করে, বৃদ্ধ না হয়ে বা যুবক না হয়েও আপনি কতটা খারাপ সময় ভোগ করছেন। না দেখছেন সূর্যের আলো না নিচ্ছেন উত্তরের বাতাসে শ্বাস। অন্ধকার আপনার প্রতিদিনের দৃষ্টির সঙ্গী। আপনি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন না।"
এরপর আত্মা তাকে বলে: "আমি যখন পৃথিবীতে বেঁচে ছিলাম তখন আমি রাজা মেন্টুহোটেপের কোষাগারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলাম এবং আমি সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্টও ছিলাম। মানুষদের নেতা এবং দেবতাদের কাছাকাছি ছিলাম। তার রাজত্বের ১৪ তম বছরে গ্রীষ্মের মাসে আমি চিরবিশ্রামে চলে যাই। উচ্চ এবং নিম্ন মিশরের রাজা, মেনটুহোটেপ। তিনি আমাকে আমার চারটি ক্যানোপিক জার এবং আমার অ্যালাবাস্টারের সারকোফ্যাগাস দিয়েছিলেন। তাছাড়াও উনি তিনি আমার অবস্থানে থাকা একজনের জন্য যা করা হয় তা আমার জন্য করেছিলেন। তিনি আমাকে শুইয়ে দিয়েছিলেন দশ কিউবিট মাপের সমাধির ভিতর, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। জানেন, সেইস্থানের নীচের মাটি খারাপ হয়ে ধ্বসে সরে চলে গেছে। সেখানে ঠান্ডা বাতাস বইছে এবং জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে। আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন 'আমি আপনার জন্য নতুন করে একটি সমাধি প্রস্তুত করে দেব'। আমি ইতিমধ্যে চারবার এরকম প্রতিশ্রুতি পেয়েছি, বলা হয়েছিল যেমন ছিল তেমনটাই করে দেওয়া হবে। কিন্তু আপনি এইমাত্র আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিলেন, যাতে এই সমস্ত কিছু কার্যকর হতে পারে, তা নিয়ে আমি কী করব?"
এরপর দেবতাদের রাজা আমুন-রে-র মহাযাজক, খোনসেমহাব, তাকে বললেন: "দয়া করে আমাকে আপনার চাহিদা মতো সেরা কাজটার কথা বলুন, যেমনটা আপনার জন্য করা উপযুক্ত হবে। আমি অবশ্যই সেটা আপনার জন্য করব। অথবা আমি [সোজাসুজি] এটা করতে পারি, পাঁচজন পুরুষ (চাকর) এবং পাঁচজন দাসী আপনার জন্য নিয়োগ করব। যারা আপনাকে রোজ পান করার জল ঢেলে দেবে। এছাড়াও আমি আপনাকে প্রতিদিন এক বস্তা করে যবের আটা সরবরাহ করব। এসব দেখাশোনা করার জন্য যে মানুষ থাকবে, সেও আপনাকে জলদান করবে।"
এসব শুনে নেবুসেমেখের আত্মা তাকে বলল : "আপনি যে কাজগুলো করবেন তাতেই বা কী লাভ? যদি একটা গাছ সূর্যালোকের সংস্পর্শে না আসে, তবে তার পাতা গজায় না। (কিন্তু) পাথরের কখনই বয়স বাড়ে না; ওটা (কেবল) ভেঙ্গে যায়..."
...রাজা নেভেপেত্রে, l.p.h., ...সেখানে দেবতাদের রাজা আমুন-রের মহাযাজক, তিনজন লোককে [দায়িত্ব দিলেন], ওরা প্রত্যেকে... এবং নৌকায় করে উপরের এলাকায় উঠে গেল... লোকেরা রাজা নেভেপেত্রের, l.p.h. [রে’র পুত্র, মেন্টুহোটেপ] পবিত্র মন্দিরের কাছে সমাধির খোঁজ করল এবং তারা ওটা খুঁজে পেল..., দেইর এল বাহরিতে রাজার চলার পথ বরাবর পঁচিশ কিউবিট দূরে অবস্থিত।
এরপর তারা নদীর তীর বরাবর ফিরে এল এবং তারা দেবতাদের রাজা, আমুন-রের মহাযাজক খোনসেমহাবের কাছে [ফিরে গেল] এবং দেখতে পেল যে উনি দেবতাদের রাজা আমুন-রের মন্দিরে দেবতার উপাসনা করছেন। উনি ওদের বললেন: "আশা করি তোমরা নেবুসেমেখ নামক আত্মার নাম অনন্তকাল ধরে রাখার জন্য এক দুর্দান্ত জায়গা আবিষ্কার করে ফিরে এসেছেন।" ওরা তিনজন তাকে একসাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলল: "আমরা [সেই মহিমান্বিত আত্মার নাম বজায় রাখার জন্য] চমৎকার জায়গা খুঁজে পেয়েছি।” বার্তা জানানোর পর ওরা মহাযাজকের উপস্থিতিতে বিশ্রাম নিল। ওরা যখন তাকে এসব বলেছিল তখন মহাযাজকের হৃদয় আনন্দিত হয়েছিল... যতক্ষণ না দিগন্ত থেকে সূর্য উঠে এল। উনি আমুন মেনকাউ অঞ্চলের সহ প্রধানকে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে তার প্রকল্প সম্পর্কে অবহিত করলেন।
ওইদিন সন্ধ্যায় উনি ফিরে এলেন নে-তে রাত কাটনোর জন্য, এবং উনি...
আলোচনা
উল্লিখিত কাহিনি হিসাবে, এটা অনুমান করা যায় যে, খোনসেমহাব তার কথা রেখেছিলেন এবং নেবুসেমেখের আত্মার জন্য এ গল্পর সমাপ্তি আনন্দের সাথে হয়েছিল। সিম্পসন উল্লেখ করেছেন যে "হাই প্রিস্ট বা মহাযাজক খোনসেমহাব সম্ভবত একটি কাল্পনিক চরিত্র ছিল" তবে থিবসের নেক্রোপলিসের যে পরিবেশে গল্পটা স্থাপন করা হয়েছে, তাতে যারা শুনেছেন তাদের কাছে বিষয়টা পরিচিত বলেই প্রতিভাত হয়েছে (১১২)। গল্পটাকে একটা চেনা পরিচিত পরিবেশে স্থাপন করা এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে আমুনের একজন মহাযাজককে বাছাই করা গল্পটাকে প্রাচীন মিশরীয় শ্রোতাদের জন্য আরও বিশ্বাসযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। ঠিক যেভাবে বর্তমান সময়ের কোনও এক সুপরিচিত ‘ভয়ঙ্কর বলে কথিত স্থানে যে কোনও ভূতের গল্প সেট করা হলে একইভাবে কাজ করে।
যদিও প্রাচীন মিশরে ভূতকে ‘ভয়ঙ্কর’ বলে মনে করা হত না; তাদের কাছে এরকম কিছু অস্তিত্বের এক প্রাকৃতিক অংশ ছিল এবং যা আসলে মিশরীয়রা মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করাত। মৃতদেহের সাথে মর্যাদাপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানগুলো নিশ্চিতভাবে করার একটাই উদ্দেশ্যে ছিল, যাতে কেউ পরকাল থেকে অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে না আসে। মৃত্যু এবং সমাধিস্থকরণের সাথে জড়িয়ে থাকা আচারগুলো সমস্ত প্রাচীন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং মিশরীয়রা তার থেকে মোটেই আলাদা ছিল না।
যেহেতু পরকালকে পৃথিবীতে একজনের জীবনের ধারাবাহিকতা হিসাবেই বিবেচনা করা হয়, এবং এটা আশা করা হয় যে মৃত ব্যক্তির আত্মাকে দেবতা ওসাইরিস দ্বারা অনুকূল মানসিকতায় বিচার করা হবে, আগত আত্মাকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হবে। তাই আত্মার কোন কারণ থাকে না মানুষের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার। যদি না কোনও সমস্যর সৃষ্টি হয়। সেই সমস্যাটা প্রায়শই হত সমাধিস্থলের ঠিকঠাক নির্মাণ না করা, সমাধিস্থল ধ্বংস হয়ে যাওয়া বা সমাধি লুটপাটের সূত্রে। সমাধিস্থলটাকে ‘আত্মার ঘর’ হিসাবে বিবেচনা করা হত এবং যদি একজনের সমাধির কথা সবাই ভুলে যায়, যদি তাকে স্মরণের যথাযথ আচার পালন না করা হয় তবে সেই আত্মা শান্তি পাবে না। ভূতের আবির্ভাব, যদি না কোনও বিশেষ কারণে তলব করা হয় বা স্বপ্নে তার আবির্ভাব ঘটে, কখনই ভালো লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হত না।
তা সত্ত্বেও, কখনও কখনও মৃতদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হত, বিশেষ সমস্যার মোকাবিলা করা বা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পরামর্শ চাওয়ার জন্য। স্বপ্নের মাধ্যমে জীবিতদের সাথে মৃতরা যোগাযোগ করতে সক্ষম বলে মনে করা হত। এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য কিছু বিজ্ঞ নারীদের অবস্থান ছিল সমাজে। তাদের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করা হত। ইজিপ্টোলজিস্ট রোজালি ডেভিডের মতে, এই নারী ভবিষ্যদ্রষ্টারা জীবিত এবং মৃতদের যোগাযোগ স্থাপনের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য মন্দিরের ভিতর বা বাইরে উভয় স্থানেই অন্ত্যেষ্টির নানান আচার অনুষ্ঠানের কাজ করতেন এবং মৃত ব্যক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় রত হতেন। উনি লিখেছেন "এই পন্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে ওরাকল এবং জাদুর ব্যবহার, মৃতদের কাছে চিঠি প্রেরণ, স্বপ্ন এবং ভবিষ্যদ্বাণীর অন্যান্য রূপভেদ" (২৭১)। খোনসেমহাবের ক্ষেত্রে, উনি মধ্যস্থতাকারীর উপর নির্ভর না করে সরাসরি ভূতকে তলব করে তার সাথে স্পষ্টভাবে কথা বলার পথ বেছে নেন এবং একজন মহাযাজক হিসাবে, উনি এ কাজ করতে সক্ষম এবং ইচ্ছুক হবেন বলেই আশা করা যায়।
এই গল্পে, নেবুসেমেখের ভূতকে ভীতিকর নয় বরং সাহায্যের প্রয়োজন এমন এক আত্মা হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গল্পটি নিয়মিত সমাধি রক্ষণাবেক্ষণ এবং মৃতদের স্মরণ ও সম্মান করার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। যখন নেবুসেমেখ আবির্ভূত হয়, তাকে খোনসেমহাব তাকে অতিথি হিসাবে অভ্যর্থনা জানায়, সেখানে কোনও ভূত ভয় দেখাতে আসেনি, মহাযাজক তাকে তার পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহায্য করতে রাজি হয়ে তাকে বিশেষ আতিথেয়তা দেখান। গল্পটা অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে বিনোদনমূলক। কিন্তু তার সাথেই শ্রোতাদের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ স্থাপনের উদ্দেশ্যও পরিবেশন করত। কারণ এ কাহিনি শ্রোতাদের মনে করিয়ে দিত যারা অন্য দিকে চলে গেছে তাদের প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার, তাদের সম্মান করা দরকার।
মৃত ব্যক্তির সামাজিক মর্যাদা যাই হোক না কেন, মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাপারটার মিশরীয়দের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক মূল্য ছিল। কিন্তু গল্পের লেখক নিশ্চিত করতে চান যে, এই বিষয়টা যেন বিশেষ গুরুত্ব পায়। তাই নেবুসেমেখকে উনি মহান বীর-রাজা ২য় মেন্টুহোটেপের ( আনুঃ ২০৬১-২০১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অধীনে থাকা সেনাবাহিনী একজন লেফটেন্যান্ট বানিয়ে দেন। এই শাসক থেবান শাসনের অধীনে মিশরকে একত্রিত করেছিলেন এবং মধ্য্কালীন সাম্রাজ্যের সূচনা করেছিলেন। ২য় মেন্টুহোটেপকে এই গল্পে রাজা বলে ধরে নিতেই পারি, কারণ গল্পে উল্লেখিত দেইর এল-বাহরির নেক্রোপোলিসে তার বিখ্যাত সমাধি তো আছেই সাথে তার খ্যাতির নানান আখ্যানও শোনা যায়।
২য় মেন্টুহোটেপের নামটা প্রায়শই অনুবাদে ( উপরের এক জায়গায়) রাহোটেপ নামেও পাওয়া যায়। ৩য় অনুচ্ছেদের লাইনের এক অনুবাদ অনুসারে ভূত বলে, "আমি যখন পৃথিবীতে জীবিত ছিলাম, তখন আমি রাজা রাহোটেপের কোষাগারের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন"। ভূতের কথা অনুযায়ী সে মেন্টুহোটেপের রাজত্বের ১৪ তম বছরে সালে মারা যান। রাহোটেপ (আনুমানিক ১৫৮০-১৫৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ১৭ তম রাজবংশের প্রথম বা দ্বিতীয় রাজা ছিলেন। ফলে তার নাম ওখানে কোনও অর্থ বহন করে না। ১১তম রাজবংশের প্রথম রাজা হিসাবে মেন্টুহোটেপ তার অনেক আগে রাজত্ব করেছিলেন।
মনে করা যেতে পারে যে, গল্পের লেখক সম্ভবত দুই রাজাকে নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ রাহোটেপ, কপ্টোসে তার ‘স্টেলা’ অনুসারে, নিম্ন মিশরে যখন হিক্সসদের আধিপত্য ছিল তখন থিবসের অধীনে দেশকে একত্রিত করে ছিলেন। এমনও হতে পারে যে রচনার সময় রাহোটেপকে পূর্ববর্তী সময়ের সমাজ নায়ক 'দ্বিতীয় মেন্টুহোটেপ' রূপে দেখানোর একটা প্রয়াস করা হয়েছিল। যে ইঙ্গিত সেই সময়ের শ্রোতাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
রাজার প্রকৃত নাম ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যতটা গুরুত্বপূর্ণ সেই নাম একজন শ্রোতার কাছে কতটা প্রভাব বিস্তার করছে: নেবুসেমেখ একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন যিনি একজন মহান রাজার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন এবং যদি তার সমাধিই এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে বা দেওয়া হয়, তাহলে তো যে কারোর সাথেই এটা হতে পারে। টুকরোগুলো থেকে প্রাপ্ত গল্প বা তার বিশদ বিবরণ মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধার গুরুত্ব এবং স্মরণের রীতির ক্রমাগত অনুশীলনের উপর জোর দেওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে।